Feeds:
পোস্ট
মন্তব্য

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?

বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-

 

ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,

খাও একা পাও যেথায় যেটুক!

বাতাবি-নেবু সকলগুলো

একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!

তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?

ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

 

কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?

দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!

 

পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!

তাই তোর নাকটি বোঁচা!

হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস

একলাই খাও হাপুস হুপুস!

 

পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!

হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!

 

ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!

আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!

কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি’ হবে? বৌদি হবে? হুঁ!

রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!

 

এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?

ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?

আর খেয়ো না পেয়ার তবে,

বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!

দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? অ’মা দেখে যাও!-

কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!

 

 

 

 

 

 

 

 

একি বেদনার উঠিয়াছে ঢেউ দূর সিন্ধু পারে

নিশীথ-অন্ধকারে।

পূরবের রবি ডুবিল গভীর বাদল-অশ্রু-ধারে

নিশীথ-অন্ধকারে।।

 

ঘিরিয়াছে দিক ঘন ঘোর মেঘে,

পুবালী বাতাস বহিছে বেগে,

বন্দিনী মাতা একাকিনী জেগে’ কাঁদিতেছে কারাগারে,

শিয়রের দীপ যত সে জ্বালায় নিভে যায় বারে বারে।

নিশীথ-অন্ধকারে।।

 

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ নীরব আজিকে মিনার-চূড়ে,

বহে না শিরাজ-বাগের নহর, বুলবুল গেছে উড়ে’।

ছিল শুধু চাঁদ, গেছে তরবার,

সে চাঁদও আঁধারে ডুবিল এবার,

শিরতাজ-হারা কাঁদে মুসলিম আস্ত-তোরণ-দ্বারে।

উঠিতেছে সুর বিদায়-বিদুর পারাবার পরপারে।

নিশীথ-অন্ধকারে।।

 

ছিল না সে রাজা-কেঁপেছে বিশ্ব তবু গো প্রতাপে তার,

শত্রুদুর্গে বন্দী থাকিয়া খোলেনি সে তরবার।

ছিল এ ভারত তারি পথ চাহি’,

বুকে বুকে ছিল তারি বাদশাহী,

ছিল তার তরে ধুলার তখত মানুষের দরবারে।

আজি বরষায় তারি তরবার ঝলসিছে বারে বার।

নিশীথ-অন্ধকারে।।*

 

*এ গীতি-কবিতা সৈয়দ আমীর আলীর স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত।

আশীর্বাদ
[কল্যাণীয়া শামসুন নাহার খাতুন জয়যুক্তাসু]

 

শত নিষেধের সিন্ধুর মাঝে অন্তরালের অন্তরীপ

তারই বুকে নারী ব’সে আছে জ্বালি’ বিপদ-বাতির সিন্ধু-দীপ।

শাশ্বত সেই দীপান্বিতার দ্বীপ হতে আঁখিদ্বীপ ভরি

আসিয়াছ তুমি অরুণিমা আলো প্রভাতী তারার টিপ পরি’।

আপনার তুমি জান পরিচয়, তুমি কল্যাণী, তুমি নারী,

আনিয়াছ তাই ভরি’ হেম-ঝারি মরু-বুকে জমজম-বারি।

অন্তরিকার আঁধার চিরিয়া প্রকাশিলে তব সত্য রূপ-

তুমি আছ, আছে তোমারো দেবার, তব গেহ নহে অন্ধকূপ।

তুমি আলোকের-তুমি সত্যের-ধরার ধূলার তাজমহল,

রৌদ্রতপ্ত আকাশের চোখে পরালে স্নিগ্ধ নীল কাজল।

আপনারে তুমি চিনিয়াছ যবে, শুধিয়াছ ঋণ, টুটেছে ঘুম;

অন্ধকারের কুঁড়িতে ফুতেছে আলোকের শতদল কুসুম।

বন্ধকারের প্রাকারে তুলেছ বন্দিনীদের জয়-নিশান-

অবরোধ রোধ করিয়াছে দেহ, পারেনি রুধিতে কণ্ঠে গান!

লহ স্নেহাশিস-তোমার ‘পুণ্যময়ী’র, ‘শামস’ পুন্যালোক

শাশ্বত হোক, সুন্দর হোক, প্রতি ঘরে চির দীপ্ত রোক!

 

 

হুগলী

১৯ মাঘ ১৩৩১

তুমি বাদশাহ গানের তখতে তখত নশীন,

সুর-লায়লীর দীওয়ানা মজনু প্রেম-রঙীন।

কণ্ঠে তোমার স্রোতস্বতীর উছল গীতি,

বিহগ-কাকলি, গন্ধব্বর-লোকের স্মৃতি।

সাগরে জোয়ার সম তব তান শান্ত উদার,

হৃদয়ের বেলাভূমে নিশিদিন ধ্বনি শুনি তার।

খেলায় তোমার সুরগুলি পোষা পাখীর মত,

মুক্ত-পক্ষ চঞ্চল-গতি লীলা-রত।

বীণার বেদনা বেণুর আকুতি তোমার সুরে,

ব্যথা-হত ভোলে ব্যথা তার, সুখী ব্যথায় ঝুরে।

সুর-শা’জাদার প্রেমিক পাগল হে গুনী তুমি,

মোর “বন-গীতি” নজরানা দিয়া দস্ত চুমি।

 

 

কলকাতা

১লা আশ্বিন ১৩৩৯

[উস্তাদ জমীরুদ্দীন খান ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম সংগীত শিক্ষক। তাঁকে কবি “বন-গীতি” গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন উপযুক্ত কাব্য-ভাষায় ।]

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!

কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!

গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!

মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!

নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী,
দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!

কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?

বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!

আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।

বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!

ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!

পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!

সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ

সাম্যের গান গাই!-
যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।
এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনি করেনিক’ কে আছে পুরুষ-নারী?
আমরা ত ছার; পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী!
তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ সে টলমল,
দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল!
আদম হইতে শুরু ক’রে এই নজরুল তক্‌ সবে
কম-বেশী ক’রে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে জবেহ্‌ !
বিশ্ব পাপস্থান
অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান্‌!
থর্মান্ধরা শোনো,
অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!
পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ!
সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ।
এদের এড়াতে না পারিয়া যত অবতার আদি কেহ
পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।
বন্ধু, কহিনি মিছে,
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব হ’তে ধ’রে ক্রমে নেমে এস নীচে-
মানুষের কথা ছেড়ে দাও, যত ধ্যানী মুনি ঋষি যোগী
আত্মা তাঁদের ত্যাগী তপস্বী, দেহ তাঁহাদের ভোগী!
এ-দুনিয়া পাপশালা,
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূণ্য-ছালা!

হেথা সবে সম পাপী,
আপন পাপের বাট্‌খারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি!
জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও,
টুপি প’রে টিকি রেখে সদা বল যেন তুমি পাপী নও।
পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং, ট্রেডমার্কার ধুম?
পুলিশী পোশাক পরিয়া হ’য়েছ পাপের আসামী গুম।

বন্ধু, একটা মজার গল্প শোনো,
একদা অপাপ ফেরেশতা সব স্বর্গ-সভায় কোনো
এই আলোচনা করিতে আছিল বিধির নিয়মে দুষি,’
দিন রাত নাই এত পূজা করি, এত ক’রে তাঁরে তুষি,
তবু তিনি যেন খুশি নন্‌-তাঁর যত স্নেহ দয়া ঝরে
পাপ-আসক্ত কাদা ও মাটির মানুষ জাতির’ পরে!
শুনিলেন সব অন্তর্যামী, হাসিয়া সবারে ক’ন,-
মলিন ধুলার সন-ান ওরা বড় দুর্বল মন,
ফুলে ফুলে সেথা ভুলের বেদনা-নয়নে , অধরে শাপ,
চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাঁদে চুম্বন-তাপ!
সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রেনীতে চন্দ্রহার,
চরণে লাক্ষা, ঠোটে তাম্বুল, দেখে ম’রে আছে মার!
প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান,
বুকে বুকে সেথা বাঁকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ।

দেবদুত সব বলে, ‘প্রভু, মোরা দেখিব কেমন ধরা,
কেমনে সেখানে ফুল ফোটে যার শিয়রে মৃত্যু-জরা!’
কহিলেন বিভু-‘তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ যে দুইজন
যাক্‌ পৃথিবীতে, দেখুক কি ঘোর ধরণীর প্রলোভন!’
‘হারুত’ ‘মারুত’ ফেরেশতাদের গৌরব রবি-শশী
ধরার ধুলার অংশী হইল মানবের গৃহে পশি’।
কায়ায় কায়ায় মায়া বুলে হেথা ছায়ায় ছায়ায় ফাঁদ,
কমল-দীঘিতে সাতশ’ হয়েছে এই আকাশের চাঁদ!
শব্দ গন্ধ বর্ণ হেথায় পেতেছে অরূপ-ফাঁসী,
ঘাটে ঘাটে হেথা ঘট-ভরা হাসি, মাঠে মাঠে কাঁদে বাঁশী!
দুদিনে আতশী ফেরেশতা প্রাণ- ভিজিল মাটির রসে,
শফরী-চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে।
ঘাঘরী ঝলকি’ গাগরী ছলকি’ নাগরী ‘জোহরা’ যায়-
স্বর্গের দূত মজিল সে-রূপে,  বিকাইল রাঙা পা’য়!
অধর-আনার-রসে ডুবে গেল দোজখের নার-ভীতি,
মাটির সোরাহী মস-ানা হ’ল আঙ্গুরী খুনে তিতি’!
কোথা ভেসে গেল-সংযম-বাঁধ, বারণের বেড়া টুটে,
প্রাণ ভ’রে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ-পুষ্প-পুটে।
বেহেশ্‌তে সব ফেরেশ্‌তাদের বিধাতা কহেন হাসি’-
‘ হার”ত মার”তে কি ক’রেছে দেখ ধরণী সর্বনাশী!’
নয়না এখানে যাদু জানে সখা এক আঁখি-ইশারায়
লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়।
সুন্দরী বসুমতী
চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয়-কাম রতি!

 

সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ

গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্ ।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
‘পূজারী দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ’ল!’
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান’, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’
সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
মসজিদে কাল শির্নী আছিল,-অঢেল গোস–র”টি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি,
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্
বলে, ‘ বাবা, আমি ভূখা-ফাকা আমি আজ নিয়ে সাত দিন!’
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
ভূখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
ভূখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ!’ গোস–র”টি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু।
তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুর”ত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
কোথা চেঙ্গিস্, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন’ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন’;-গ্রন’ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে
আমাতে মহামহিম।

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্ উ”চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন’ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে!
ও কে? চন্ডাল? চম্কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!
ওই হ’তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ।
রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!
চাষা ব’লে কর ঘৃণা!
দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র’বে চিরকাল।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,
দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।
সে মার রহিল জমা-
কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!

বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা,
তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্খানে!
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি’।

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া,
বলি থাম্ একটু দাঁড়া!

পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই- চড়েছি,
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াত্ করে
পড়েছি সড়াত্ জোরে৷

পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের অ অড়েই,
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুসি
একদম জোর্ সে ঠুসি!
আমিও বাগিয়ে থাপর
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙ্ নু দেয়াল,
দেখি এক ভিট্ রে শেয়াল!
আরে ধ্যাত্ শেয়াল কোথা?
ভুলোটা দাঁড়িয়ে হোথা!
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জুড লে ছোটা!
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই কর্ বে সাবাড়!
‘বাবা গো মা গো’ বলে’
পাঁচিলের ফোঁকল গলে
ঢুকি গ্যে’ বোস্ দের ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!

যাব ফের? কান মলি ভাই
চুরিতে আর যদি যাই!
তবে মোর নামই মিছা!
কুকুরের চাম্ ড়া খিঁচা
সে কি ভাই যায়রে ভুলা-
মালীর ঐ পিট্ নী গুলো-
কি বলিস্? ফের হপ্তা?
তৌবা-নাক খপতা!

বন্ধু আমার! থেকে থেকে কোন্‌ সুদূরের বিজন পুরে

ডাক দিয়ে যাও ব্যথার সুরে?

আমার অনেক দুখের পথের বাসা বারে বারে ঝড়ে উড়ে,

ঘর-ছাড়া তাই বেড়াই ঘুরে।।

তোমার বাঁশীর উদাস কাঁদন

শিথিল করে সকল বাঁধন

কাজ হ’ল তাই পথিক সাধন,

খুঁজে ফেরা পথ-বঁধরে,

ঘুরে’ ঘুরে’ দূরে দূরে।।

হে মোর প্রিয়! তোমার বুকে একটুকুতেই হিংসা জাগে,

তাই তো পথে হয় না থামা-তোমার ব্যথা বক্ষে লাগে!

বাঁধতে বাসা পথের পাশে

তোমার চোখে কান্না আসে

উত্তরী বায় ভেজা ঘাসে

শ্বাস ওঠে আর নয়ন বুঝে,

বন্ধু, তোমার সুরে সুরে।।

-ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ

Come silently like the Moon – Kazi Nazrul Islam

O, my love
Come silently in the middle of the night
As gliding moonlight

With your tender touch
Bring sweet dreams to my eyes

O, my love, never again
I will need to open the door,
Come quietly through the door of my heart
Be there forever in my sweet memory

Come as the fragrance of un-blossomed flowers
Swaying in the evening breeze
Sing out my name over and over again
Like love-stricken evening bird in the wilderness

Come as tear drops in my eyes
Whisper in my ears like soothing tune of flute
Come as my lost love
O my ever lost love
Be there as eternal pain in my heart.

English version by
Gulshan Ara